ঢাকাSunday , 18 February 2024
  • অন্যান্য

নরসিংদী অঞ্চলের পিঠার ইতিহাস,ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্য

নিজস্ব প্রতিনেদক
February 18, 2024 6:32 pm । ১২০ জন
Link Copied!

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

পিঠা বাঙালির জীবনে এক জনপ্রিয় অনুসঙ্গ। পিঠার সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালির আবহমান কালের রঙ্গ-রসনা, শিল্প-সংস্কৃতি ও আনন্দ উল্লাস। পিঠা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি তাই এর আবেদন নিবেদন ছুঁয়েছেনে আছে বাঙালির রসনা জগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

আমাদের বেঁচে থাকার অতি আদিম অবলম্বন ছিল প্রকৃতি প্রদত্ত ফলমূল,পশুপাখি, জীবজন্তু-তারপর কৃষি।প্রকৃতিপ্রদত্ত খাদ্যদ্রব্যের প্রাপ্তি প্রাচুর্যতা ধীরে ধীরে কমে এলে মানুষ ক্রমশ ফসল উৎপাদন অর্থাৎ কৃষিকে বেঁচে থাকার আশ্রয় হিসাবে ভাবতে শুরু করে। আর কৃষিজাত ফসলের নান্দনিক ও বিচিত্রমাত্রিক ব্যবহার বিস্তারই পিঠাশিল্পের সূত্রপাত।এই শিল্প লোকজ ও ঐতিহ্যবাহী।
অসংখ্য নদী-নালা, হাওড়-বাওড়, বিল-ঝিল, অবারিত ফসলের মাঠ,ষড়ঋতুর রূপটান গাঙ্গেয় নিম্নাঞ্চলের মানুষকে যেমন করেছে উদার ও খোলামনের তেমনই করেছে ভোজনরসিক।আগেকার দিনে খোলা গ্রামাঞ্চলে মানুষের খাবার-দাবার ছিল প্রকৃতিপ্রদত্ত ও নিজস্ব উৎপাদিত। নদী-নালায় সাঁতার কেটে, খোলামাঠে খেলাধুলা করে, মেঠো সুরে গান গেয়ে,সবাই ভাগাভাগি করে নিজ হাতে তৈরি খাবার খেয়ে অতি আনন্দে জীবন-যাপন করতো।

আগেকার দিনে ভাগাভাগি করে খাবার খেতে অভ্যস্ত বাঙালি মিলেমিশে নানান কাজও করতো। এভাবে দলগত ও সমষ্টিগত ভাবে কাজ করতে করতে একজন আরেক জনের কাছ থেকে শিখেছে রন্ধনপ্রনালী,বিভিন্ন খাবার তৈরিকরণ ও ফসলের বিচিত্রমাত্রিক ব্যবহার-অর্থাৎ পিঠা তৈরি। নতুন ফসল ঘরে তোলার পর আগেকার দিনের মা-চাচিরা,দাদি-নানিরা,বৌ-ঝিয়েরা ঘরের দাওয়ায় বসতো অথবা উঠোনে বসতো নতুন চালের পিঠা বানাতে। সেখানে এসে জড়ো হতো আশেপাশের পাড়াপড়শিরা,সেই পিঠা তৈরির আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতো ছোটরাও।গ্রামে যারা ভালো নকসীপিঠা বানাতে পারতো তাদের বিশেষ কদর ছিল।

এভাবে যৌথ প্রচেষ্টায় ছোট-বড়দের সম্মিলিত সুন্দর সহযোগিতায় তৈরি হতো বিচিত্র খাবার, বিচিত্র পিঠা।

এভাবেই ছোটরা বড়দের কাছ থেকে শিখে নিত নতুন নতুন পিঠা তৈরির কলা-কৌশল ও রন্ধনপ্রনালী। পরবর্তীতে এক গ্রামের মেয়ে অন্য গ্রামে বিয়ে হলে সে মেয়ে সাথে নিয়ে যেতো পিঠা তৈরির নতুন শিল্প ভাবনা,কলা-কৌশল ও নতুন রন্ধনপ্রনালী। আগেকার দিনে এভাবেই গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তো পিঠাশিল্প,লোকশিল্প,গ্রামীণ জীবন হয়ে ওঠতো কারুকার্যময়, পিঠাময় ও শিল্পময়।

সমগ্র গ্রাম-বাংলায় সারাবছর পিঠা তৈরি ও স্বাদগ্রহণের রেওয়াজ থাকলেও শীতকালই পিঠা খাওয়ার মোক্ষম সময়।অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে পিঠাপুলির শুভ সূচনা হতো(এখনো হয়)।আর তা চলতে থাকে মাঘ-ফালগুন পর্যন্ত।আগেকার দিনে গ্রামবাংলায় কৃষকরা দেশী জাতের ধান চাষ করতো। ধানের নাম গুলোও ছিল বেশ কাব্যিক। সূর্যমণি, কিরণ,ধাইরল, জাগলি, লাহি, বালাম, লাতাবোরো,
গইন্যাবোরো,আছমইত্তা,খামা,আমন, দুধবাদাল, নির্ভয়, হাইট্টা আরো কতো প্রকার ধান! এসব ধানের চাল ছিল খুবই সুস্বাদু ও সুঘ্রাণ যুক্ত। এসব ধান ঢেঁকিকলে অথবা গাইল-ছেহাইটে ছেটে চাল করা হতো তারপর করা হতো চালগুঁড়া।ধানভানা অথবা গাইল-ছেহাইট দিয়ে চালগুঁড়া করার শব্দ ছন্দে মুখরিত হতো পাড়াগাঁ। তখন এক ধরণের পুলক ও সুখবোধ সঙ্গোপনে সঞ্চার হতো গ্রামীণ মানুষের মনোজগতে। হাতে ছাটা চাল ও চালগুঁড়ার সুঘ্রাণে খুব আচ্ছন্ন হতো কৃষাণ-কৃষাণী,পাড়াপড়শি।বিশেষ করে নতুন জামাই শ্বশুর বাড়ি এলে তাকে হরেকরকম পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ ছিল শাশ্বত কালের।খুব প্রভাতে কারো বাড়িতে ঢেঁকিকলের অথবা গাইল-ছেহাইটের শব্দ শোনা গেলে ধরে নেয়া হতো সেই বাড়িতে নতুন জামাই এসেছেন চলছে পিঠা বানানোর পর্ব।

একেক মৌসুমে একেক পিঠা তৈরি ও স্বাদগ্রহণের রেওয়াজ ছিল গ্রাম-বাংলায়। সারাবছর পিঠার স্বাদগ্রহণ করা হলেও ঋতুভিত্তক নানান পিঠার নানান স্বাদগ্রহণে অভ্যস্ত ছিল গ্রামের মানুষ।ভাদ্রমাসে তালপিঠা খুবই জনপ্রিয়। পিঠার খামির সাথে তালের রস মাখিয়ে তালপিঠা তৈরি ও এসবের স্বাদগ্রহণের পুলকপর্ব মনে রাখার মতো।তালপিঠার মধ্যে তালের বড়া,তালের চাপটি,তালটিক্কা,তালের গোল্লা ইত্যাদি খুবই জনপ্রিয়।শীতকালে নরসিংদী অঞ্চলে যে পিঠা গুলো সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় এসবের মধ্যে ভাপাপিঠা, ভর্তাপিঠা, পুলিপিঠা, চিতইপিঠা, দুধচিতই, দুধপুলি, রসপিঠা, ভিজাপিঠা, কাউনপিঠা ও জামাইপিঠা খুবই জনপ্রিয়।শীতকালে খেজুররস ও আখরস পাওয়া যায় তাই খেজুর ও আখের ঘন রসে ডুবিয়ে চুবিয়ে খাওয়া হয় রসপিঠা। তবে অনুষ্ঠান ও পার্বণ ভেদে পিঠায় আসে বৈচিত্র্য।

আগে বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে তেলের পিঠা(ডুগাপিঠা), পাকনপিঠা, নাড়ু, পাতাপিঠা, জামাইপিঠা, পাটিসাপটা, নকসিপিঠা, সেমাই ও হাতসয় খায়ানোর প্রচলন ছিল। বরের বাড়ির লোকদেরকে সাত রকমের পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করার প্রচলন ছিল। তাছাড়া কনের সাথে(প্রথম শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময়)টুকরি বা বোল ভর্তি করে দেওয়া হতো ডুগাপিঠা, ঝুরিভাজা, নকসিপিঠা, হাতসয় ও পাতাপিঠা।
ঈদের সময় সবার ঘরে ঘরে নকসিপিঠা(ফুলপিঠা), নারকেলপিঠা, সমুচা, হাতসয়, নাড়ু, পাতাপিঠা,ঝুরিভাজা ও সয় সেমাই খাওয়ার প্রচলন এখনো আছে।সনাতন ধর্মের তারা পুজোর সময় নারকেলের নাড়ু,পাটিসাপটা, লাড্ডু,গজা,বরফি,বুরিন্দা,মুরালি,দুধসন্দেশ, হালুয়া ও মুয়া খেতে পছন্দ করে। নরসিংদীর চর এলাকার মানুষ নানান উৎসবে ঘরে তৈরি বিশালাকার জিলেপি দিয়ে মেহমানদারি করতে অভ্যস্ত।এটা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ।

তাছাড়া তারা ডুগাপিঠা, কাউনখির,মোরব্বা, পায়েশ ও খির খেতে পছন্দ করে। নরসিংদীর কিছু কিছু অঞ্চলে হাতনাটাই, সিরিঞ্জপিঠা, কাঁচাপিডা ও মাড়ি খেতে অভ্যস্ত। শেকড় গজানো ধান থেকে চাল করে সেই চালগুঁড়া দিয়ে বানানো হয় কাঁচাপিঠা।তাছাড়া তিল ও চালগুঁড়া দিয়ে বানানো হয় সুস্বাদু মাড়ি।আমাদের নরসিংদীর গ্রামীণ মানুষ সচরাচর যে পিঠা গুলো দিয়ে সকালের নাস্তা করে থাকে এসবের মধ্যে বিভিন্ন রকম চাপটি, মেরাপিঠা, ভর্তাপিঠা, চিতইপিঠা, ভাপাপিঠা, মুঠি বা মুইট্টা ও পুলিপিঠা অন্যতম।

যান্ত্রিকতার যাঁতাকলে,গতি ও দ্রুতি’র উলম্ফনে গ্রাম-বাংলার মানুষের ধ্যানজ্ঞানেও জেঁকে বসেছে ফাস্টফুড, প্যাকেটফুডের কৃত্তিমতা। ধাবমান জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এবং যৌথ জীবনের বলয়-বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে আমিত্ববাদ,কর্তৃত্ববাদ ও এলিয়েনেশন-এর যুগে আমাদের লোকজমাঠ ও মনন মনীষায় বেশ পরিবর্তন এলেও নরসিংদীর গ্রামাঞ্চলে ও শহরের রুচিশীল মানুষের রসনাজগতে এখনো পিঠা এক নান্দনিক নাম।বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিঠার কদর উৎকর্ষতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।সেই স্বপ্নাঙ্খাকার পথ ধরে আরো নতুন নতুন পিঠার শৈল্পিক সৌকর্ষতার রূপটানে মুগ্ধ হচ্ছি আমরা।বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও নরসিংদী জেলা শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় সম্প্রতি নরসিংদীতে যে তিনদিন ব্যাপি পিঠা উৎসব হয়েছে সেখানে বাহারী ও বিচিত্র পিঠার উপস্থাপন  সেটাই প্রমাণ করে।

বিশিষ্ট কবি ও ছড়াকার মো. মহসিন খোন্দকার বলেন,  নরসিংদী অঞ্চলে নতুন যে পিঠা গুলো আমাদের রসনাজগতকে সমৃদ্ধ করছে বা করে যাচ্ছে এসবের মধ্যে খেজুরপিঠা, মুগপাকন, মুঠিপিঠা, ঝিনুকপিঠা, নারকেলবকুল, কদমসুন্দরি, নোলক পিঠা, শিউলিফুল পিঠা, তক্তাপিঠা, হাতসেমাই, মিষ্টিকুমড়া পিঠা, ঝালপুলি,
শাহী লাড্ডু, ডিমকাটলেট, সাঁঝপিঠা, সতীনমোচড়,
আনারস পিঠা, নিমপাতা পিঠা, গাজরলাড্ডু, ডিমপিঠা,
সবজিপিঠা ও কাঁঠালপিঠা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। বিজ্ঞানের বেগ,আধুনিকতার চোরাটান,বিচ্ছিন্নতার বিচ্ছিরি বোধ-ভাবনা আমাদেরকে ভীষণ ভাবে আচ্ছন্ন করলেও আমাদের শেকড় থাকুক লোকজ নান্দনিকতায়।এখনো নিজহাতে তৈরি খাবারই নিজের জন্যে শ্রেষ্ঠ।